-->

মধ্যযুগের মানুষ টিকার ব্যবহার না জানায় ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক "ব্ল্যাক ডেথ" বা প্লেগ মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল।১৯২০ এর স্প্যানিশ ফ্লু এর পর সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাস ও ভালোই তান্ডবলীলা চালিয়েছে।যদিও টিকা আবিষ্কারের পর কোভিডের মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।তো এই টিকা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। 

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় টিকার ভূমিকা (Role of Vaccine in Immune System):

রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা জীবাণুর নির্যাস বা জীবাণু সৃষ্ট পদার্থ (টক্সিন) কিংবা সংশ্লেষিত বিকল্প পদার্থ থেকে উৎপন্ন রাসায়নিক বস্তু যা অ্যান্টিজেনের মতো আচরণ করে দেহে অ্যান্টিবডি উৎপন্নে উদ্দীপনা জোগায় এবং এক বা একাধিক রোগের বিরুদ্ধে দেহকে অনাক্রম্য করে তোলে তাকে ভ্যাক্সিন (vaccine) বলে। শরীরে মারাত্মক রোগের ভ্যাক্সিন দেয়া থাকলে ভবিষ্যতে ঐসব রোগ দেহকে অসুস্থ করতে পারে না। ভ্যাক্সিন প্রয়োগ টিকা দেয়া নামে পরিচিত ।

ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner) ১৭৯৬ সালে গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ইমিউনোলজির সূচনা করেন এর অনেক বছর পর ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) ১৮৮১ সালে অ্যানথ্রাক্স ভ্যাকসিন এবং ১৮৮৫ সালে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। বর্তমানে যক্ষ্মা, টাইফয়েড, হুপিং কাঁশি, পোলিও, হাম, হেপাটাইটিস-বি, কোভিড-১৯ ইত্যাদি রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু মরণব্যাধি AIDS ও হেপাটাইসিস-সি এর ভ্যাকসিন আজও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি ।

একটি আদর্শ ভ্যাকসিনের বৈশিষ্ট্য :

 ১. এটি সুস্থিত, সস্তা, সহজলভ্য, নিরাপদ এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াবিহীন ।

২. এটি স্বল্প মাত্রায় কার্যকর।

৩. এটি জীবাণুর জন্য ক্ষতিকর, তবে পোষক বা গ্রহীতার জন্য ক্ষতিকর নয়।

৪. এর কার্যকারিতা দীর্ঘদিন বা সারাজীবন বজায় থাকে।

৫. এটি গ্রহীতার দেহে সারাজীবন বা দীর্ঘকালীন অনাক্রম্যতা সৃষ্টি করে ।

৬. এটি খুব দ্রুত অনাক্রম্যতার সূচনা করে । 

৭. এটি সুনির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে দেহকে প্রতিরোধী করে তুলে ।

৮. মায়ের অনাক্রম্যতাকে সন্তানে সঞ্চারিত করে ।

ভ্যাক্সিনের প্রকারভেদ:

উৎপাদনের ধরনের উপর ভিত্তি করে ভ্যাক্সিন নিচে বর্ণিত ৫ প্রকার :

১. মৃত বা নিষ্ক্রিয় (Killed or Inactivated) :

রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে রাসায়নিক, তাপ, অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় জীবাণু থেকে উৎপন্ন। যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, পোলিও, হেপাটাইটিস A প্রভৃতি ভ্যাক্সিন ।

২.শক্তি হ্রাস (Attenuated): 

কালচার করা, ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল করে দেয়া জীবিত জীবাণু উৎপন্ন যেমন—মিজলজ (হাম), মাম্পস, পানিবসস্ত (চিকেন পক্স), টাইফায়েড প্রভৃতি রোগের ভ্যাক্সিন ।

৩. টক্সোয়ড (Toxoid) : 

জীবাণুর নিষ্ক্রিয় বিষাক্ত পদার্থ থেকে উৎপন্ন । যেমন-টিটেনাস (ধনুষ্টংকার), ডিপথেরিয়া প্রভৃতির ভ্যাক্সিন । 

৪. উপএকক বা সাবইউনিট (Subunit) : 

জীবাণুগাত্রের সামান্য অংশ (নির্দিষ্ট প্রোটিনের অংশ) থেকে উৎপন্ন। যেমন-হেপাটাইটিস-B ভ্যাক্সিন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ভ্যাক্সিন প্রভৃতি ।

৫. অনুবন্ধী বা কনজুগেট (Conjugate) : 

দুটি ভিন্ন উপাদানে গঠিত ভ্যাক্সিন (ব্যাকটেরিয়ার দেহ আবরণের অংশ বাহক প্রোটিন)। যেমন- হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-৮ (Haemophilus influenzae type-b, Hib) ভ্যাক্সিন।

টিকা তৈরির কৌশল:

আক্রমণকারী বা রোগ প্রতিরোধকারী অণুজীবকে কোনো নির্ধারিত জীবকোষে আবাদ করে সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। কালচারকৃত এসব অণুজীবকে রসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিশোধন করে সংরক্ষণ করা হয় । এরপর অণুজীবগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় বা নিষ্প্রাণ করে টিকা তৈরি করা হয়। বিভিন্ন প্রকার টিকা বিভিন্ন উৎস থেকে তৈরি করা হয়। অনেকসময় জিন প্রকৌশল প্রক্রিয়ায় জিন ক্লোনিং করে অথবা জিন সংশ্লেষ করে টিকা তৈরি করা হয়। টাইফয়েড জ্বরের টিকা Salmonella typhi নামক ব্যাকটেরিয়ার মৃতকোষ দিয়ে তৈরি করা হয়। র‍্যাবিস রোগের টিকা Rabies ভাইরাসের অর্ধমৃত দেহ হতে তৈরি করা হয়।

ভ্যাক্সিনেশন (Vaccination):

ভ্যাক্সিন প্রয়োগের মাধ্যমে অণুজীবের, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস-এর সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায়কে ভ্যাক্সিনেশন বলে। প্রক্রিয়াটি সাধারণভাবে টিকা দেয়া (inoculation) নামে পরিচিত। নির্দিষ্ট রোগের ভ্যাক্সিন নির্দিষ্ট জীবাণু থেকেই সংগ্রহ ও উৎপন্ন করা হলেও প্রক্রিয়াগত কারণে এ পদার্থ মানবদেহে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বা রোগ সৃষ্টির পরিবর্তে দেহকে রোগমুক্ত রাখতে, রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। রোগের চিকিৎসায় ভ্যাক্সিনের ব্যবহার পদ্ধতিকে ভ্যাক্সিনোথেরাপি (vaccinotherapy) বলে ।

ড. এডওয়ার্ড জেনার (Dr. Edward Jenner) ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম গুটিবসন্তের (small pox) ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যুগান্তকারী 'ভ্যাক্সিন বিপ্লব' ঘটিয়ে মানুষের রোগমুক্ত দীর্ঘ সুন্দর জীবনের যে প্রত্যাশা জাগিয়েছেন তার ধারাবাহিকতায় আজ দ্বিতীয় জেনারেশন (Second Generation) ভ্যাক্সিন হিসেবে হেপাটাইটিস-B ভ্যাক্সিন উৎপন্ন হয়েছে কিন্তু AIDS ভ্যাক্সিন আজও আবিষ্কৃত হয়নি ।

ভ্যাক্সিনেশনের ফলে মানবদেহ এমন সব রোগ থেকে রক্ষা পায় যা থেকে শুধু অসুখ-বিসুখই নয়, দেহ পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের ইমিউনতন্ত্রকে বাড়তি শক্তি যোগাতে ভ্যাক্সিন নিম্নোক্তভাবে সক্রিয় থাকে। 

১. অধিকাংশ ভ্যাক্সিনে রোগসৃষ্টিকারী মৃত বা দুর্বল জীবাণুর সামান্য অংশ থাকে। দেহে রোগসৃষ্টি করতে পারে এমন সক্রিয় জীবাণু থাকে না । কোন কোন ভ্যাক্সিনে জীবাণু একেবারেই থাকে না । 

২. জীবাণুর অংশবিশেষসহ ভ্যাক্সিন যে দেহে প্রবেশ করে অ্যান্টিবডি সৃষ্টির মাধ্যমে ওই নির্দিষ্ট জীবাণুর প্রতি দেহকে অনাক্রম্য করে তোলে এসব অ্যান্টিবডি নির্দিষ্ট রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করে।

৩.মানবদেহে দুভাবে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হতে পারে। (ক) অসুস্থ হলে এবং (খ) ভ্যাক্সিন নিলে। জীবাণুর আক্রমণে অসুস্থ হয়ে রোগে ভুগে কষ্ট শেষে অ্যান্টিবডি উৎপাদনের চেয়ে আগেভাগেই সম্ভাব্য রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা বেশি নিরাপদ। কারণ জীবাণুর আক্রমণে দেহ অসুস্থ হলে সম্পূর্ণ নিরোগ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ দেহ বিকলাঙ্গ হতে পারে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কুৎসিত দাগ হতে পারে, কিংবা জীবনহানিও ঘটতে পারে। অতএব, ভ্যাক্সিনের মতো অস্ত্র থাকতে আমরা কেন দুর্ভোগ পোহাব?

৪.ভ্যাক্সিন গ্রহণের ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি দেহে দীর্ঘদিন বা আজীবন উপস্থিত থাকে। অ্যান্টিবডিগুলো জানে কিভাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হয় অতএব, ভ্যাক্সিন নেয়ার পর ভবিষ্যতে যদি আসল জীবাণু দেহে প্রবেশ করে তাহলে অ্যান্টিবডির কৌশলে দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র জীবাণু ধ্বংসে সক্রিয় হবে।

 ৫. অনেক ভ্যাক্সিন আছে যা একবার নিলে আজীবন দেহে কর্মক্ষম থাকে। মাঝে-মধ্যে অতিরিক্ত ডোজ (booster shot) নিতে হয় । 

 ৬.কিছু ভ্যাক্সিন রয়েছে যা মিশ্র ভ্যাক্সিন নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে কয়েকটি রোগের ভ্যাক্সিন যুক্ত করে দেহে প্রবেশ করানো হয়, যেমন- MMR ( Measles, Mumps and Rubella) ভ্যাক্সিন ।

৭. প্রতিটি মানবদেহ (শিশু বা বয়স্ক) নির্দিষ্ট রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পূর্ণ থাকে কিন্তু সবার প্রতিরক্ষাতন্ত্র এক ও সবল নয় বলে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সবল করা হয় । শিশু বয়সে কয়েকটি রোগের ভ্যাক্সিন নেয়া থাকলে পরিবারও থাকে নিশ্চিন্ত।

ভ্যাক্সিনের প্রয়োজনীয়তা :What is the importance of Vaccines?

শৈশব ও কৈশোরকালীন সময়ে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হয়। পোলিও, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়াসহ অন্যান্য মারাত্মক জীবন ঝুঁকিপূর্ণ ও আজীবন কষ্টকর রোগ-ব্যাধির কবল থেকে নিজের বংশধরকে বাঁচাতে সবাই তৎপর থাকেন। সুস্থ পরিবার ও জাতি গড়তে সুস্থ-সবল বংশধর প্রয়োজন। এ কারণে শৈশবেই ভ্যাক্সিন দেয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সব সরকার বিবেচনা করে থাকে ।

ভ্যাক্সিন সুষ্ঠুভাবে কাজ করে, এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সামান্য । পৃথিবীতে প্রতিবছর ৩ মিলিয়ন লোকের জীবন রক্ষা হয়। এবং রোগের কষ্ট থেকে ও স্থায়ী বিকলাঙ্গ হওয়া থেকে রক্ষা পায় আরও কয়েক মিলিয়ন মানুষ ।

নিচে ভ্যাক্সিনের প্রয়োজনীয়তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:

১. বিভিন্ন ভ্যাক্সিন প্রয়োগে দেহে সক্রিয় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন সংক্রামক রোগকে প্রতিহত করা সম্ভব হয় ।

২. শিশুদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করে শিশু মৃত্যুর হার কমানো যায় । 

৩. পোলিও, গুটিবসন্ত প্রভৃতি সংক্রামক রোগের জীবাণুকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল চিত্র করতে ভ্যাক্সিনেশন পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । 

৪. কিছু ভ্যাক্সিন যেমন- DPT (Diptheria Pertusis Tetanus), OPV (Oral Polio Vaccine), MMR (Measles Mumps Rubella), BCG (Bacillus Culmitte Guerin) প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ব থেকে এ রোগগুলো নির্মূলের প্রচেষ্টা চলছে।

৫. বর্তমানে সবচেয়ে মারাত্মক মরণব্যাধি AIDS- কে প্রতিরোধ করার জন্য ভ্যাক্সিনেশন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

অতএব, দুশ্চিন্তাহীন জীবন যাপনের জন্য শুধু নিজের সন্তানকেই নয়, সমাজের প্রত্যেক পিতা-মাতার কাছে ভ্যাক্সিনেশনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা প্রয়োজন। 

আরো দেখুন :

ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশনের পার্থক্য

প্রস্বেদন একটি অপ্রয়োজনীয় অমঙ্গল কেন?
-->