-->

নিউটন, আইনস্টাইন, ম্যাক্সওয়েল-পদার্থবিজ্ঞানের তিন মহারথী।যদিও এঁরা সকলেই পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন,তবুও তাঁদের মৌলিক তত্ত্বগুলোর মাঝে বিবাদ আছে।গ্যালিলিওর পথ ধরে নিউটন তার সূত্র গুলো ব্যাখ্যা করেন।পরবর্তীতে নিউটনের সূত্র দিয়ে যখন কিছু ঘটনা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে,তখন ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব এর সাহায্যে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সূত্র নিয়ে আসেন। 

নিউটন আলোকে কণা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন কিন্তু ম্যাক্সওয়েল তার বিখ্যাত সমীকরণ দিয়ে দেখান যে,আলো আসলে একটি বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। 

কণাতত্ত্ব : “কোন উজ্জ্বল বস্তু থেকে অনবরত ঝাঁক ঝাঁক অতি ক্ষুদ্র কণা নির্গত হয়। এ কণাগুলো প্রচ- বেগে সরলরেখা বরাবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যখন আমাদের চোখে গিয়ে আঘাত করে তখন ঐ বস্তু সম্পর্কে আমাদের দর্শানুভূতি হয়। কণাগুলোর বিভিন্ন আকারের জন্য বিভিন্ন বর্ণের সৃষ্টি হয়।” আলোর প্রকৃতি সম্বন্ধে এ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন স্যার আইজাক নিউটন ১৬৭২ সালে। এই তত্ত্বের সাহায্যে আলোর ঋজুগতি, প্রতিফলন, প্রতিসরণ ইত্যাদি আলোকীয় ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ব্যাতিচার, সমবর্তন, বিচ্ছুরণ ইত্যাদি ঘটনার কোন ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না।

তরঙ্গতত্ত্ব :

আলো ইথার নামে এক কাল্পনিক মাধ্যমের ভিতর দিয়ে তরঙ্গ আকারে  সঞ্চালিত হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায় এবং আমাদের চোখে পৌঁছে দর্শনের অনুভূতি সৃষ্টি করে। ইথারকে কল্পনা করা হয় একটি নিরবচ্ছিন্ন মাধ্যম রূপে যার স্থিতিস্থাপকতা অনেক বেশি কিন্তু ঘনত্ব খুবই কম। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খুব কম এবং নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ নির্দিষ্ট বর্ণের অনুভূতি সৃষ্টি করে। ১৬৭৮ সালে হাইগেন প্রথম এই তত্ত্ব প্রদান করেন। পরে ইয়ং, ফ্রেনেলসহ আরো বিজ্ঞানী এটি প্রমাণ করেন।

এই তত্ত্বের সাহায্যে প্রতিফলন, প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, ব্যাতিচার ও অপবর্তন ব্যাখ্যা করা গেলেও সমবর্তন, আলোক তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায়নি। এছাড়া মাইকেলসন, মর্লি প্রমাণ করেন ইথার বলে কিছু নেই। ফটোতড়িৎক্রিয়া এই তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই ঘটনার ব্যাখ্যা করেন।ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে প্রথম এই তত্ত্ব প্রদান করেন। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন এই তত্ত্বের প্রমাণ করেন। যার জন্য ১৯১১ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তিনি দেখান, কোন কোন ধাতুর উপর আলো পড়লে তাৎক্ষণিক ইলেকট্রন নির্গত হয় যাকে ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া বলে।

কোয়ান্টাম তত্ত্বটি এরকম যে,“আলোকশক্তি কোন উৎস থেকে অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের আকারে না বেরিয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুচ্ছ বা প্যাকেজ আকারে বের হয়।” প্রত্যেক রঙের আলোর জন্য এ শক্তি প্যাকেটের শক্তির একটা সর্বনিম্ন মান আছে। এই সর্বনিম্নমানের শক্তিসম্পন্ন কণিকাকে কোয়ান্টাম বা ফোটন বলে।

আইনস্টাইনের আরেকটা তত্ত্ব নিউটনের তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে যায়।নিউটন পরম স্থান ও কালে বিশ্বাস করতেন। বাস্তবে পরম অবস্থান বা কথিত পরম স্থান নামক জিনিসটির অভাব নিউটনকে চিন্তিত করে তোলে, কারণ এটা তাঁর পরম ঈশ্বরের ধারণার সাথে খাপ খাচ্ছিল না। এবং তিনি পরম স্থানের অভাবকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন, যদিও তাঁর নিজেই সূত্রই দিয়েছিল তার বিপরীত ইঙ্গিত । এই অযৌক্তিক বিশ্বাসের জন্য অনেকেই তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন।

নিউটন সময়কেও পরম করতেন। অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভালো একটি ঘড়ির সাহায্যে কয়েকজন পর্যবেক্ষক দুটো ঘটনার মধ্যবর্তী সময় সঠিকভাবে মাপতে পারবেন এবং যে কারো মাপা সময় একই পাওয়া যাবে। পরম স্থানের ধারণা নিউটনের সূত্রে ভুল মনে হলেও পরম সময়ের ব্যাপারে এতে কোনো রকম অসংগতি ছিল না। অধিকাংশ মানুষও একেই স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নেবে কিন্তু বিংশ শতকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, স্থান এবং সময় দুটো সম্পর্কেই প্রচলিত ধারণা বদলে ফেলতে হবে।তাঁরা আবিষ্কার করলেন যে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান নির্ভর করছে পর্যবেক্ষকের ওপর। তাঁরা আরও আবিষ্কার করলেন, সময় স্থান থেকে একেবারে আলাদা ও স্বতন্ত্র নয়। আলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান এই উপলব্ধির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে । একে আমাদের অভিজ্ঞতার বিপরীত মনে হতে পারে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ধীর বস্তু যেমন আপেল বা গ্রহদের বেলায় আমাদের সহজাত ধারণা বেশ ভালো কাজ করলেও আলোর সমান বা কাছাকাছি বেগে চলন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে তা একেবারেই অকেজো।অর্থাৎ, নিউটনের তত্ত্ব কেবল ম্যাক্রোস্কোপিক বস্তু,যার বেগ আলোর বেগের সাথে তুলনীয় নয়,শুধু তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। 

আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে একটি বস্তু কখনোই আলোর সমান গতি অর্জন করতে পারবে না। কারণ ততক্ষণে এর ভর হয়ে যাবে অসীম। আর ভয় ও শক্তির সমতুল্যতা অনুসারে আলোর গতিতে গতিশীল  করতে হলে খরচ করতে হবে অসীম পরিমাণ শক্তি। এই কারণেই যেকোনো সাধারণ বস্তু সব সময় আলোর চেয়ে অল্প গতিতে চলতে বাধা হয়। আলো বা যেসব তরঙ্গদের অভ্যন্তরীণ কোনো ভর নেই, তারাই কেবল আলোর সমান গতিতে চলতে পারে।

আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব একটি বৈপ্লবিক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত । কথাটি হলো, মহাকর্ষ আসলে অন্যান্য বলের মতো কোনো বল নয়। আগে স্থান-কালকে সমতল মনে করা হতো, সার্বিক । আর মহাকর্ষ এই অসমতল স্থান-কালেরই ফলাফল। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে ভর ও শক্তির উপস্থিতিতে স্থান-কাল বেঁকে যায়। পৃথিবীর মতো বস্তুরা মহাকর্ষ নামক কোনো বলের কারণে বক্র কক্ষপথে চলছে না, বরং বক্র কক্ষপথে চলার কারণ হলো, এরা বক্র স্থানে সরলরেখা বরাবর নিকটতম বস্তুকে অনুসরণ করে।

১৯১৫ সালের আগে স্থান ও কালকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল ধরা হতো, যেখানে কোনো ঘটনা ঘটে, কিন্তু যা ঘটবে তা এদেরকে (স্থান-কাল) প্রভাবিত করবে না। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও এটা সত্য ছিল। বক্তরা চলছে, বল আকর্ষণ-বিকর্ষণ করছে, কিন্তু স্থান ও কাল চলছে নির্বিঘ্নেই । সময় ও স্থান অবিরত চলছে এমন ভাবাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে অবস্থা একেবারে ভিন্ন। এখানে স্থান ও কাল হলো গতিশীল রাশি। একটি বস্তু চললে বা কোনো বল ক্রিয়াশীল হলে প্রভাবিত হয় স্থান ও কালের বক্রতা। ফলশ্রুতিতে বস্তু কীভাবে চলবে এবং বল কীভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করে স্থান-কালের গঠনের ওপর। মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তাকে স্থান-কাল শুধু প্রভাবিতই করে না, তা দ্বারা নিজেরাও প্রভাবিত হয়। স্থান-কালের ধারণা ছাড়া যেমন আমরা মহাবিশ্বের কোনো ঘটনা বোঝাতে পারি না, তেমনি সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের সীমানার বাইরের স্থান-কালও আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি না। ১৯১৫ সালের পরবর্তী দশকগুলোতে স্থান-কালের এই নতুন জ্ঞান মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ভাবনায় বিপ্লব সূচিত করে। আগে মনে করা হতো মহাবিশ্বে কোনো পরিবর্তন নেই। এটা যুগ যুগ ধরে বিরাজমান ছিল এবং চিরকাল টিকে থাকবে। এই ভাবনা বদলে গেল। এর স্থানে এল গতিশীল ও সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা। এখন মনে হচ্ছে এটি একটি নির্দিষ্ট সময় আগে শুরু হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পরে এর ইতি ঘটবে ।

আরো দেখুন:

অরবিট ও অরবিটালের পার্থক্য

নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স

-->