অ্যামাইলোজ এবং আমাইলোপেকটিন নামক দুটি পলিস্যাকারাইডের সমন্বয়ে গঠিত পদার্থই হলো স্টার্চ। উদ্ভিদে স্টার্চ (শ্বেতসার) সঞ্চিত পদার্থরূপে বিরাজ করে। ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট চিনির অধিকাংশই পরিবর্তিত হয়ে স্টার্চ-এ পরিণত হয়। স্টার্চ সাধারণত ঘনীভূত দানা হিসেবে (starch grain) উদ্ভিদ কোষে বিরাজ করে এবং এদের দানার আকার ও আকৃতি বিভিন্ন উদ্ভিদে বিভিন্ন রকম। বীজ, ফল, কন্দ (tuber) প্রভৃতি সঞ্চয়ী অঙ্গে স্টার্চ জমা থাকে। ধান, গম, আলু স্টার্চের প্রধান উৎস। সালোকসংশ্লেষণে তৈরি অধিকাংশ গ্লুকোজই স্টার্চে রূপান্তরিত হয়। বিভিন্ন স্টার্চের আকার আকৃতিতে বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। আয়োডিন দ্রবণে স্টার্চ গাঢ় নীলবর্ণ ধারণ করে। স্টার্চ হাইড্রোলাইসিসের ফলে গ্লুকোজ-এ পরিণত হয়।
অসংখ্য α-D গ্লুকোজ অণু নিয়ে স্টার্চ গঠিত। গ্লাইকোসাইডিক বন্ধনের প্রকৃতি অনুযায়ী স্টার্চ দু'প্রকার, যথা-অ্যামাইলোজ ও অ্যামাইলোপেকটিন। সাধারণত 200 থেকে 1000 টি গ্লুকোজ অণু নিয়ে একটি অ্যামাইলোজ তৈরি হয়। এর অণু-শৃঙ্খল অশাখ। অ্যামাইলোপেকটিন সাধারণত 2000 থেকে 2,00,000 টি গ্লুকোজ অণুবিশিষ্ট হয়। অ্যামাইলোপেকটিনের গ্লুকোজ অণুগুলো কার্বনের 1,4 বন্ধন ছাড়াও 1,6 বন্ধনে যুক্ত থাকে। এর অণু-শৃঙ্খল শাখান্বিত। আলু, ধান, গম, ভুট্টা, যব ইত্যাদির স্টার্চে শতকরা ২২ ভাগ অ্যামাইলোজ এবং ৭৮ ভাগ অ্যামাইলোপেকটিন থাকে। অ্যামাইলোজ থাকায় স্টার্চের দ্রবণে আয়োডিন যোগ করলে কালবর্ণ (কাল-নীল) ধারণ করে। কিন্তু অ্যামাইলোপেকটিনের সাথে বিক্রিয়া করে আয়োডিন লাল বা পার্পল রং প্রদান করে। স্টার্চের দীর্ঘ অণু আকৃতি ও আয়তনের স্থায়ী কণিকা গঠন করে থাকে। স্টার্চ আণুবীক্ষণিক এবং প্রজাতি বিশেষে কণিকার গঠনে পার্থক্য থাকে। যেমন- গোল আলুর স্টার্চ কণিকা সবচেয়ে বৃহত্তম আর চালের স্টার্চ কণিকা সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম।
(i) স্টার্চ গন্ধহীন, কর্ণহীন, স্বাদহীন এবং সাদা পাউডার জাতীয় জৈব-রাসায়নিক পদার্থ।
(ii) সাধারণ তাপমাত্রায় স্টার্চ পানি, ইথার ও অ্যালকোহলে অদ্রবণীয়।
(iii) আয়োডিন দ্রবণে স্টার্চ নীল বর্ণ ধারণ করে।
(iv) উচ্চ তাপমাত্রায় স্টার্চ ভেঙ্গে ডেক্সট্রিন ও ম্যালটোজ হয়ে গ্লুকোজ-এ পরিণত হতে পারে।
(v) ফেলিং দ্রবণ স্টার্চ কর্তৃক বিজারিত হয় না।
![]() |
পাউডার আকৃতির স্টার্চ,ছবি: istock |
উদ্ভিদদেহে স্টার্চ প্রধানত সঞ্চিত খাদ্য হিসেবে বিরাজ করে।
আয়োডিন দ্রবণে স্টার্চ নীল বর্ণ ধারণ করে। কারণ স্টার্চের অ্যামাইলোজ উপাদান আয়োডিন অণুকে আবদ্ধ করে জটিল যৌগ গঠন করে। ফলে আয়োডিন পরমাণুগুলোর ইলেকট্রন অরবিটালের পরিবর্তন ঘটে এবং সূর্যালোক ব্যবহার করে নীল বর্ণ সৃষ্টি করে।
(i) স্টার্চ প্রধানত খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়।
(ii) সালোকসংশ্লেষণে তৈরি স্টার্চ ব্যবহৃত হয়।
(iii) অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে যেমন—গ্লুকোজ, অ্যালকোহল ও চোলাই মদ তৈরিতে।
(iv) স্টার্চ গ্লুকোজে পরিণত হয়ে জীবদেহে শক্তি ও কার্বন অণু সরবরাহ করে থাকে।
(v) কাগজ ও আঠা প্রস্তুত করতেও স্টার্চ ব্যবহৃত হয়।
(i) সেলুলোজ স্বাদহীন, গন্ধহীন, সাদা ও কঠিন জৈব-রাসায়নিক পদার্থ।
(ii) এটি পানিতে অদ্রবণীয়, অবিজারক পদার্থ, আণবিক ভর দুই লক্ষ থেকে কয়েক লক্ষ ।
(iii) এটি মিষ্টি নয় এবং বিজারণ ক্ষমতাহীন।
(iv) আয়োডিন দ্রবণ প্রয়োগে কোনো রং দেয় না।
(v) এটি ফাইবার সদৃশ ও শক্ত।
(vi) এটির কোনো পুষ্টিগুণ নেই।
সেলুলোজ উদ্ভিদের গাঠনিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। উদ্ভিদকে দৃঢ়তা ও সুরক্ষা প্রদান করে এবং তার ভার বহন করে।
নিম্নে সেলুলোজের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
(i) উদ্ভিদের কোষ প্রাচীর সেলুলোজ নির্মিত
(ii) সেলুলোজ দিয়ে তন্ত্র তৈরি হয়, যা বস্ত্রশিল্পের প্রধান কাঁচামাল ।
(iii) এটি নাইট্রেট বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
(iv) এটি অ্যাসিটেট ফটোগ্রাফিক ফিল্মে ব্যবহার করা হয়। ফিল্টার পেপার, টিস্যু পেপার, ফটোগ্রাফিক ফিল প্যাকেজিং এর দ্রব্যসমূহ সেলুলোজ দিয়ে তৈরি হয় ।
(v) নির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্র তৈরিতে সেলুলোজ প্রধান উপাদান হিসেবে যান্ত্রিক সাহায্য প্রদান করে থাকে।
(vi) কাঠখেকো কীটপতঙ্গের পৌষ্টিকনালীতে বসবাসকারী এক ধরনের পরজীবী সেলুলেজ নামক উৎসেচক নিঃসৃত করে কাঠ হজমে সাহায্য করে।
(vii) থিন লেয়ার ক্রোমাট্রোগ্রাফিতে স্টেশনারিফেজ হিসেবে সেলুলোজ ব্যবহৃত হয়।
(viii) ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়া থেকে উৎপাদিত সেলুলোজ বর্তমানে বায়োটেকনোলজিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
(ix) গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর পরিপাকতন্ত্রে সেলুলোজ হজমকারী এনজাইম তৈরি হয় না। তৃণভোজী স্তন্যপায়ী যেমন- গরু, ছাগল, মহিষ, হরিণ ইত্যাদির পরিপাকতন্ত্রে এক ধরনের মিথোজীবী ব্যাক্টেরিয়া বাস করে যারা সেলুলোজ হজমকারী এনজাইম সেলুলেজ উৎপাদন করে। সেলুলোজে বিদ্যমান β-1,4 গ্লাইকোসাইডিক লিংকেজ ভেঙ্গে সেলুলোজকে হজমে সাহায্য করে। মানুষের পরিপাকতন্ত্রে এ ধরনের কোনো মিথোজীবী ব্যাক্টেরিয়া না থাকায় মানুষ সেলুলোজ হজম করতে পারে না। কিন্তু মানুষের খাদ্য তালিকায় আঁশ জাতীয় খাদ্য থাকা দরকার, কেননা সেলুলোজ মল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
গ্লাইকোজেন হলো একটি পুষ্টিজাত পলিস্যাকারাইড। এটি প্রাণিদেহের প্রধান সঞ্চিত খাদ্য উপাদান হলেও সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীলাভ সবুজ শৈবাল) ও কতিপয় ছত্রাকের (ঈস্ট) সঞ্চিত খাদ্য হিসেবে বিরাজ করে। গ্লাইকোজেনের মূল গাঠনিক একক হলো α-D গ্লুকোজ। অ্যামাইলোপেকটিনের মতো এর অণু শৃঙ্খলও শাখান্বিত। 1, 6 লিংকেজের মাধ্যমে শাখার সৃষ্টি হয়। প্রতি শাখায় সাধারণত ১০ থেকে ২০টি গ্লুকোজ অণু থাকে। হাইড্রোলাইসিস শেষে গ্লাইকোজেন হতে কেবল α-D গ্লুকোজ অণু পাওয়া যায়। প্রাণিদেহের যকৃত (লিভার) ও মাংসপেশিতে বেশি করে গ্লাইকোজেন জমা থাকে যা প্রয়োজনে গ্লুকোজে পরিণত হয়ে কার্বন ও শক্তি সরবরাহ করে। এজন্য গ্লাইকোজেনকে প্রাণিজ স্টার্চ বলে। ফরাসি শারীরতত্ত্ববিদ Claude Bernard ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে গ্লাইকোজেন আবিষ্কার করেন।
(i) গ্লাইকোজেন পানিতে আংশিক দ্রবণীয়।
(ii) এটি সাদা পাউডার জাতীয় জৈব-রাসায়নিক পদার্থ।
(iii) আয়োডিন দ্রবণ প্রয়োগে লালচে বেগুনি বর্ণ ধারণ করে।
(iv) ঠাণ্ডা পানিতে এটি কলয়েড সাসপেনশন তৈরি করে।
(v) তাপ দিলে এর লাল বর্ণ চলে যায়।
(vi) ঠাণ্ডা অবস্থায় কালো বর্ণ ফিরে আসে।
(vii) আংশিক আর্দ্র-বিশ্লেষিত হয়ে ম্যালটোজ, আর পূর্ণ আর্দ্র-বিশ্লেষিত হয়ে α-D গ্লুকোজ অণু প্রদান করে।
(viii) গ্লাইকোজেন গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় আর্দ্র-বিশ্লেষিত হয়ে গ্লুকোজ অণু সৃষ্টি করে।
(ix) যকৃতের গ্লাইকোজেন গ্লুকোজে পরিণত হয়ে রক্তে প্রবাহিত হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
![]() |
যকৃতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন ভেঙে গ্লুকোজ উৎপন্ন হয়।ছবি: istock |
(i) পেশিতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন পেশির কাজে শক্তি যোগায়।
(ii) যকৃতের গ্লাইকোজেন ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণত করে।
(iii) এটি রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
সঞ্চিত খাদ্য হিসেবে কাজ করে।
তো এবার তিনটি পলিস্যাকারাইড এর তুলনা করা যাক:
আরো দেখুন:
-->