-->

 আজকের সভ্যতাকে এ পর্যন্ত আনতে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তা হলো বিদ্যুৎ বা তড়িৎ।বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য মাধ্যম বা পরিবাহী দরকার।এই পরিবাহী দু ধরনের হতে পারে।আমাদের আজকের আলোচনা এই দু ধরনের পরিবাহী এবং এদের পার্থক্য নিয়ে।

More:পারমাণবিক বর্ণালির সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

ধাতব পরিবাহী:

যেসব পদার্থের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহের মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তাদের ধাতব বা ইলেকট্রনীয় পরিবাহী বলে।ধাতব মৌলের পরমাণুর সর্ববহিস্থ শক্তিস্তরে প্রচুর মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। প্রয়োজনীয় বিভব পার্থক্য আরোপ করলে এ মুক্ত ইলেকট্রনগুলো ধাতব পরমাণুগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এভাবে ধাতব পদার্থের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহের মাধ্যমে তড়িৎ প্রবাহ ঘটে । অর্থাৎ ধাতব পরিবাহীতে বা বৈদ্যুতিক চার্জ চলমান ইলেকট্রন দ্বারা পরিবাহিত হয় কিন্তু ধাতুর মূল অংশ নিউক্লিয়াসে স্থির থাকে। যে কারণে পদার্থের মূল গঠনের কোনো পরিবর্তন পরিবহন ঘটে না। তাপমাত্রার বৃদ্ধির সাথে ধাতব পরিবাহীর তড়িৎ ক্ষমতার হ্রাস ঘটে। তবে কঠিন পদার্থের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রন তথা তড়িৎ প্রবাহের সময় সেটির ভৌত পরিবর্তন ঘটে। যেমন- কঠিন পদার্থটির তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে। 

ধাতুর এক পরমাণু হতে অপর পরমাণুতে ইলেকট্রনের চলাচলের মাধ্যমে তড়িৎ প্রবাহিত হয় বলে ধাতব পরিবাহীকে ইলেকট্রনীয় পরিবাহী বলে। যেমন কপার, অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, সিলভার, দস্তাসহ সব ধাতব পদার্থ এবং ধাতুসংকর এ শ্রেণির মধ্যে পড়ে। যেহেতু ইলেকট্রনীয় পদ্ধতিতে পদার্থের কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটে না তাই এটি একটি ভৌত প্রক্রিয়া। । তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে কঠিন পদার্থের কিছু পরিবর্তনও ঘটে।

ধাতব পরিবাহীর বৈশিষ্ট্য :

1.ধাতব মৌলের পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষের মুক্ত ইলেকট্রনগুলোর প্রবাহ তড়িৎ প্রবাহের সৃষ্টি করে।

2. কঠিন পদার্থের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের সময় সেটির ভৌত পরিবর্তন ঘটে। যেমন— কঠিন পদার্থ উত্তপ্ত হয় । 

3. তড়িৎ পরিবহনকালে কঠিন ধাতব পরিবাহীর মধ্যে কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে না।

4 জাতীয় পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি।

5.এসব পরিবাহীর ক্ষেত্রে ওহমের সূত্র প্রযোজ্য।

6. তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতার হ্রাস ঘটে।

পারদ তরল মৌলিক পদার্থ হলেও এর মধ্য দিয়ে ইলেকট্রনের প্রবাহ ঘটে। পারদ একটি ইলেকট্রনীয় তড়িৎ পরিবাহী। 

তড়িৎবিশ্লেষ্য পরিবাহী বা ইলেকট্রোলাইটিক পরিবাহী (Electrolytic Conductors):

তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ (Electrolytes) : 

যেসব যৌগ গলিত বা উপযুক্ত দ্রাবকে (যেমন-পানিতে) দ্রবীভূত অবস্থায় আয়নিত হয়ে তড়িৎ প্রবাহ ঘটায় এবং তড়িৎ প্রবাহের ফলে উক্ত আয়নগুলোর জারণ-বিজারণ (Red-Ox) বিক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে নতুন পদার্থ উৎপন্ন হয় সেসব যৌগিক পদার্থকে তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ বলা হয় । দাহরণস্বরূপ : এসিড, ক্ষার, লবণ ইত্যাদি আয়নিক যৌগগুলো তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ।

এসিড: HCl, H–COOH,CH3COOH,HNO3 ইত্যাদি তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ।

ক্ষার:NaOH,KOH, Mg(OH)2,Ca(OH)2, NH4OH  ইত্যাদি তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ।

লবণ :NaCl, KCI,CaCl2, AgNO3, FeSO4ZnSO4CuSO4,HCOONa।

দ্রবণে অথবা গলিত অবস্থায় আয়নিক যৌগের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নগুলো কেলাসের ল্যাটিস কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে গতিশীল হয়। এ অবস্থায় বিপরীতধর্মী আয়নগুলো তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। তখন আয়নগুলোর মধ্যে তড়িৎ শক্তির প্রভাবে জারণ-বিজারণ ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আয়নিক যৌগের জলীয় দ্রবণে ও গলিত অবস্থায় তড়িৎ পরিবহন করাতে তড়িৎ বিশ্লেষণ হয়। এরূপ পরিবাহীকে তড়িৎবিশ্লেষ্য পরিবাহী বলে। তড়িৎবিশ্লেষ্যের সঞ্চারণশীল ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়ন দ্বারা তড়িৎ প্রবাহ ঘটে।

জলীয় দ্রবণে আয়নিক যৌগ ও পোলার সমযোজী যৌগের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নগুলো যথাক্রমে ইলেকট্রন গ্রহণ ও ত্যাগ করে জারণ- বিজারণ বিক্রিয়ায় রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তড়িৎ পরিবহন করে। এরূপ তড়িৎ পরিবাহীকে তড়িৎবিশ্লেষ্য পরিবাহী বলে।

কোনো তড়িৎবিশ্লেষ্যের তড়িৎ পরিবহনের ক্ষমতাকে পরিবাহিতা (conductance) বলা হয়। ওহমের সূত্রটি শুধু ধাতব পরিবাহিতার ক্ষেত্রেই নয় তড়িৎবিশ্লেষ্য পরিবাহীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।

তড়িৎবিশ্লেষ্য পরিবাহীর বৈশিষ্ট্য :

1. এসিড, ক্ষার, ক্ষারক ও লবণ জাতীয় পদার্থসমূহ গলিত অবস্থায় অথবা উপযুক্ত দ্রাবকে দ্রবীভূত অবস্থায় উৎপন্ন আয়নের সাহায্যে তড়িৎ পরিবহন করে। অর্থাৎ তড়িৎবিশ্লেষ্যের গতিশীল ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়ন দ্বারা তড়িৎ প্রবাহ ঘটে। এ অবস্থায় আয়নগুলোর মধ্যে তড়িৎ শক্তির প্রভাবে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

2. তড়িৎ প্রবাহকালে অ্যানোড তড়িদদ্বারে জারণ ও ক্যাথোড তড়িদদ্বারে বিজারণ ঘটে। অর্থাৎ তড়িৎ পরিবহনের ফলে পদার্থের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। এ প্রক্রিয়াকে আয়নিক যৌগের তড়িৎ বিশ্লেষণ বলে।

3.আয়নের চলাচলের মাধ্যমে তড়িৎ পরিবাহিত হয় বলে এ পদ্ধতিতে তড়িৎ পরিবহনের সাথে সাথে পদার্থের স্থানান্তর ঘটে থাকে।

 4.উত্তপ্ত অবস্থায় পরিবাহীতে তড়িৎ পরিবহনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

5. এ জাতীয় পরিবাহীর ক্ষেত্রে ফ্যারাডের সূত্র প্রযোজ্য।

6. একই আয়ন প্রভাবের কারণে তড়িৎবিশ্লেষ্যের তড়িৎ বিয়োজন মাত্রা হ্রাস পায়। ফলে তড়িৎ পরিবাহিতা হ্রাস পায়।

এছাড়াও তড়িৎ পরিবাহিতার সাথে সম্পৃক্ত আরেকটা বিষয় হলো:

সুপার কন্ডাক্টর (Super Conductor) : 

বিভিন্ন ধাতুর নির্দিষ্ট সংযুক্তিতে সংকর ধাতু তৈরি করা হয়েছে। এসব সংকর ধাতুর একটি নির্দিষ্ট সন্ধি তাপমাত্রা (T.) থাকে। এ তাপমাত্রার নিচে এ জাতীয় ধাতব পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎ পরিবহনের ক্ষেত্রে সুপার কোনো বৈদ্যুতিক রোধ থাকে না। ইলেকট্রন কোনো ধরনের শক্তির ক্ষয় ছাড়াই মাধ্যমের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।এদেরকে সুপার কন্ডাক্টর বলে। যেমন Nb3Ge এর T. হলো 23.2K।

এখন,ধাতব পরিবাহী ও ইলেকট্রনীয় পরিবাহীর পার্থক্য জেনে নিই:

ধাতব পরিবাহী

ইলেকট্রনীয় পরিবাহী

১.ধাতব পরিবাহীর ক্ষেত্রে ধাতব পদার্থের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন সঞ্চালন দ্বারা তড়িৎ প্রবাহের উদ্ভব ঘটে।

১.তড়িৎবিশ্লেষ্যের ক্ষেত্রে দ্রবণের মাধ্যমে আয়নের সঞ্চালন দ্বারা তড়িৎ প্রবাহ সম্পন্ন হয়।

২.ধাতব পরিবাহীতে তড়িৎ পরিবহনের সময় কোনো ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয় না। এটি একটি ভৌত প্রক্রিয়া। তবে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে ফলে মাধ্যম উত্তপ্ত হয়।

২.তড়িৎবিশ্লেষ্যের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের ক্ষেত্রে তড়িৎবিশ্লেষ্যের উপাদানের বিয়োজন ঘটে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে নতুন উপাদানের সৃষ্টি হয়।

৩.ধাতব পরিবাহীর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের প্রবাহ পরিবাহী মাধ্যমের যে দিকে ঘটে তড়িৎ প্রবাহ ঠিক তার বিপরীত দিকে ঘটে থাকে। অর্থাৎ ইলেকট্রনের প্রবাহ ও তড়িৎ প্রবাহ পরস্পর সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

৩.তড়িৎবিশ্লেষ্যের ক্ষেত্রে দ্রবণের মধ্যে আয়নের প্রবাহ যেদিকে তড়িৎ প্রবাহ ঐ একই দিকে ঘটে। অর্থাৎ আয়নের প্রবাহ ও ইলেকট্রনের প্রবাহ একই অভিমুখে চলে।

৪.ধাতব পরিবাহীর ক্ষেত্রে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটলে তড়িৎ পরিবাহিতার হ্রাস ঘটে এবং তাপমাত্রার হ্রাস ঘটলে পরিবাহিতার বৃদ্ধি ঘটে। অর্থাৎ পরিবাহিতা ও তাপমাত্রা বিপরীতমুখী।

৪.তাপমাত্রার বৃদ্ধি পেলে আয়নগুলোর চলাচল কয়েক গুণ বেড়ে যায় ফলে পরিবাহিতে প্রবাহিত তড়িতের পরিবাহিতার বৃদ্ধি ঘটে। একইভাবে তাপমাত্রার হ্রাস ঘটলে পরিবাহিতার হ্রাস ঘটে।

৫. ধাতব পরিবাহিতার ক্ষেত্রে বাহ্যিক চাপের তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায় না।

৫.তড়িৎবিশ্লেষ্যের ক্ষেত্রে বাহ্যিক চাপের বৃদ্ধি ঘটালে তড়িৎ পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায়।

৬.কঠিন অথবা তরল উভয় অবস্থাতেই তড়িৎ পরিবহন করে।

৬. শুধুমাত্র গলিত অথবা পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায়

তড়িৎ পরিবহন করে। কঠিন অবস্থায় নয়।

৭.জড়বস্তুর স্থানান্তর ঘটে না।

৭.জড়বস্তুর স্থানান্তর ঘটে না।

৮.ধাতব পরিবাহীর ক্ষেত্রে কুলম্বের সূত্র প্রযোজ্য।

৮.তড়িৎ বিশ্লেষ্য পরিবাহীর ক্ষেত্রে ফ্যারাডের সূত্র প্রযোজ্য।

৯.একটি সুনির্দিষ্ট বিভব বৈষম্যের জন্য প্রবাহমাত্রা বেশি।

৯.বিভব বৈষম্যের জন্য প্রবাহমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম।

চৌম্বক তথ্য:

ফ্যারাডের সূত্র:

দ্রবণে বা গলিত অবস্থায় কোনো তড়িৎবিশ্লেষ্য মাধ্যমের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চালনা করলে প্রতি তড়িৎদ্বারে উৎপন্ন বা দ্রবীভূত পদার্থের গ্রামে প্রকাশিত ভর তড়িৎবিশ্লেষ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তড়িতের সমানুপাতিক। 

ওহমের সূত্র:

তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রবণের ঘনমাত্রা,তাপমাত্রা ও তড়িদদ্বার অপরিবর্তিত থাকলে,যখন কোনো পরিবাহীর দুই বিন্দুর মধ্যে তড়িৎ প্রবাহিত হয়,তখন তা দুই বিন্দুর মধ্যে বিদ্যমান বিভব পার্থক্যের সমানুপাতিক হয়।

More from this blog :

Newton versus Einstein

-->