-->

সালোকসংশ্লেষণ এর সংজ্ঞায় আমরা সবসময় সূর্যের  আলোর কথা বলে থাকলেও সালোকসংশ্লেষণের মূল কাজ,শর্করা তৈরির জন্য কিন্তু সরাসরি সূর্যের আলো দরকার হয় না।সূর্যের আলো থেকে রাসায়নিক শক্তি নিয়ে আলোক পর্যায়ে কিছু যৌগ তৈরি হয়,যাতে শক্তি সঞ্চিত থাকে এবং সেই শক্তি ব্যবহার করে আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়ে কার্বন আত্মীকরণের মাধ্যমে গ্লুকোজ তৈরি হয়।

আলোক নিরপেক্ষ অধ্যায় (Light independent phase) : 

কার্বোহাইড্রেট তৈরি বা কার্বন বিজারণআলোকনির্ভর অধ্যায়ে সৃষ্ট ATP ও NADPH+H+ বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে CO2 হতে কার্বোহাইড্রেট (শর্করা) সংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। এ অধ্যায়ে CO2 বিজারিত হয়ে কার্বোহাইড্রেট উৎপাদন করে বলে একে কার্বন বিজারণ অধ্যায় বলা হয়। কার্বন বিজারণ প্রক্রিয়ায় কোনো আলোর প্রত্যক্ষ প্রয়োজন পড়ে না, তাই একে আলোক নিরপেক্ষ অধ্যায়ও বলা হয়। তবে আলোর উপস্থিতিতেই কার্বন বিজারণ হয়ে থাকে। এর কারণ আলোর উপস্থিতিতে ATP ও NADPH+H+ সরবরাহ নিশ্চিত হয় এবং স্টোম্যাটা খোলা থাকায় CO2 ও Oবিনিময় সহজ হয়।

আলোক নিরপেক্ষ পর্যায় (বা কার্বন বিজারণ) এর বিক্রিয়াসমূহ ক্লোরোপ্লাস্টের স্ট্রোমাতে সংঘটিত হয়। আলোক অধ্যায় সম্পন্ন না হলে হলো আলোক নিরপেক্ষ অধ্যায় ঘটবে না। আবহমণ্ডলের CO2 হতে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বোহাইড্রেট সৃষ্টির তিনটি স্বীকৃত পথ আছে, তা হলো— (১) ক্যালভিন চক্র, (২) হ্যাচ ও স্ল্যাক চক্র এবং (৩) CAM (Crassulacean Acid Metabolism) প্রক্রিয়া।

কোষে সংঘটিত মেটাবলিক বিক্রিয়াসমূহ পর্যায়ক্রমিকভাবে ঘটে থাকে যাকে বলা হয় গতিপথ (Pathway)। অধিকাংশ উদ্ভিদই ক্যালভিন চক্র অনুসরণ করে।

(১) ক্যালভিন চক্র : C3 চক্র (Calvin cycle : C3 cycle) : ১৯৪৭-১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালভিন ও তাঁর সহযোগীরা (Melvin Calvin, 1911-1997, Benson & Bassham) তেজস্ক্রিয় কার্বন (কার্বনের আইসোটোপ) ব্যবহার করে সন্ধানী পদ্ধতিতে (tracer technique) Chlorella নামক এককোষী শৈবালে বর্বন বিজারণের যে চক্রাকার গতিপথ আবিষ্কার করেন তা ক্যালভিন চক্র নামে পরিচিত। এই বিশেষ অবদানের জন্য ক্যালভিন  ১৯৬১ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

সংক্ষেপে ক্যালভিন চক্র নিম্নরূপ :

(ক) কার্বন যোগ (কার্বোক্সাইলেশন) :

১। CO(এক কার্বনবিশিষ্ট) ক্লোরোপ্লাস্টের স্ট্রোমাতে প্রবেশ করে পূর্ব থেকে অবস্থিত ৫--কার্বনবিশিষ্ট Ribulose 1,5 bisphosphate CO এর সাথে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে ৬-কার্বনবিশিষ্ট সম্পূর্ণ অস্থায়ী কিটো এসিড।কাজেই ক্যালভিন চক্রে COএর গ্রহীতা হলো RuBP। রুবিস্কো এনজাইম এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

CO2 এক কার্বনবিশিষ্ট, আর গ্লুকোজ ৬ কার্বনবিশিষ্ট, তাই এক অণু গ্লুকোজ তৈরি করতে হলে ৬ বার CO2 যুক্ত হতে হবে অর্থাৎ চক্রটি ৬ বার সম্পন্ন হতে হবে। ৬ চক্রে ১২ অণু 3PGA তৈরি হয় ।

Related:প্রস্বেদন একটি অপ্রয়োজনীয় অমঙ্গল কেন?

(খ) ফসফেট যোগ (ফসফোরাইলেশন)

৩। ATP থেকে একটি ফসফেট গ্রহণ করে 3-ফসফোগ্লিসারিক অ্যাসিড, 1, 3-বিসফসফোগ্লিসারিক অ্যাসিড-এ (BPGA) পরিণত হয়। এখানে একটি ATP খরচ হয় এবং ১টি ADP মুক্ত হয়। এখানে 3 ফসফোগ্লিসারেট কাইনেজ এনজাইম বিক্রিয়ায় সহযোগিতা করে থাকে।

১২ অণু 3PGA থেকে ১২ অণু BPGA তৈরি হয়; ১২টি ATP খরচ হয়, ১২টি ADP মুক্ত হয়। । 

(গ) হাইড্রোজেন যোগ (রিডাকশন):

৪। 1, 3-বিসফসফোগ্লিসারিক অ্যাসিড বিজারিত হয়ে  3-ফসফোগ্লিসারল্ডিহাইডে (3PGD) পরিণত হয়। এখানে একটি ফসফেট হাইড্রোজেন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। NADPH+H+বিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে এবং NADP হিসেবে মুক্ত হয় অর্থাৎ এর জারণ ঘটে।ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইম এ বিক্রিয়ায় সহায়তা করে। 3PGD একটি ৩-কার্বনবিশিষ্ট কার্বোহাইড্রেট ।

[ ১২ অণু BPGA থেকে ১২ অণু 3PGD তৈরি হয়; ১২টি NADPH+H+ অংশ গ্রহণ করে, ১২টি NADP ও ১২টি Pi মুক্ত হয়। ]

ক্যালভিন চক্রে উৎপন্ন প্রথম চিনি (কার্বোহাইড্রেট) হলো 3PGD। 3PGD  হতে পরবর্তী বিক্রিয়ার মাধ্যমে RuBP পুন:উৎপন্ন করে চক্রটি চালু রাখে এবং গ্লুকোজ উৎপন্ন করে সকল জীবের খাবার, শরীর গঠন ও শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করে। এক অণু গ্লুকোজ তৈরি করতে ১৮টি ATP ও ১২টি NADPH+H+ দরকার হয়, শক্তি খরচ হয় ৬৮৬ Kcal।

(ঘ) RuBP পুনঃউৎপাদন এবং দ্রব্য উৎপাদন

১২টি 3PGD তে (১২ x ৩ = ৩৬) ৩৬টি কার্বন আছে। এর মধ্যে ১০টি 3PGD (৩০টি কার্বন) বিভিন্ন বিক্রিয়ার
মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ৬টি ৫-কার্বনবিশিষ্ট (৫ × ৬ = ৩০) RuBP পুনঃউৎপাদন করে। ২টি 3PGD হতে (৩ x ২ = ৬ কার্বন) বিভিন্ন বিক্রিয়া শেষে ১ অণু গ্লুকোজ সৃষ্টি হয় এবং গ্লুকোজ থেকে পরে সুকরোজ, স্টার্চ, সেলুলোজ (যা কোষ, টিস্যু ও অঙ্গ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় অথবা জমা হয়) ইত্যাদি দ্রব্য উৎপাদন করে। অন্য বায়োকেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় এই সরল চিনি থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, লিপিড এবং নিউক্লিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়।

৫। এক অণু গ্লিসারাল্ডিহাইড 3- ফসফেট, ট্রায়োজ ফসফেট আইসোমারেজ এনজাইমের সহায়তায় এক অণু ডাইহাইড্রক্সি অ্যাসিটোন 3-ফসফেট-এ পরিণত হয়।

৬। এক অণু ডাইহাইড্রক্সি অ্যাসিটোন 3-ফসফেট এবং এক অণু গ্লিসারেল্ডিহাইড 3-ফসফেট মিলিতভাবে সৃষ্টি করে এক অণু ফ্রুক্টোজ 1, 6-বিসফসফেট। অ্যালডোলেজ এনজাইম এ বিক্রিয়ায় সহায়তা করে।

৭। ফ্রুক্টোজ 1, 6-বিসফসফেট এক অণু পানি গ্রহণ করে সৃষ্টি করে ফ্রুক্টোজ 6-ফসফেট। এখানে এক অণু ফসফেট মুক্ত হয়। ফসফ্যাটেজ এনজাইম এ বিক্রিয়ায় সহায়তা করে।

৮। ফ্রুক্টোজ 6-ফসফেট, গ্লিসারেল্ডিহাইড 3-ফসফেটের সাথে মিলিতভাবে (৬+৩ = ৯ কার্বন) সৃষ্টি করে এক অণু জাইলুলোজ 5-ফসফেট (৫ কার্বন) এবং এক অণু ইরিথ্রোজ 4-ফসফেট (৪ কার্বন)। ট্রান্সকিটোলেজ এনজাইম এ বিক্রিয়ায় সহায়তা করে। ইরিথ্রোজ ৪-ফসফেট আরো কয়েকটি বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই চক্রের পরবর্তী পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়।

৯। জাইলুলোজ 5-ফসফেট ইপিমারেজ এনজাইমের সহায়তায় রাইবুলোজ 5-ফসফেট-এ পরিণত হয়। ১০। রাইবুলোজ 5-ফসফেট, রাইবুলোজ 5-ফসফেট কাইনেজ এনজাইমের সহায়তায় ATP থেকে এক অণু ফসফেট গ্রহণ করে রাইবুলোজ 1, 5-বিসফসফেট (RuBP) পুনঃউৎপাদন করে। এখানে এক অণু ADP মুক্ত হয়।

আচ্ছা,এবার সালোকসংশ্লেষণ এর আলোক পর্যায়ের কথা মনে করি। অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশনে সমান সংখ্যক ATP এবং বিজারিত NADP তৈরি হয়।কিন্তু C3 cycle চলার সময় NADP এর চেয়ে ATP বেশি খরচ হয়।এই অতিরিক্ত ATP চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন থেকে আসে।

এবার যদি আলোক পর্যায় ও আলোক নিরপেক্ষ পর্যায় এর পার্থক্য দেখে নিই তাহলে:

আলোক পর্যায় আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়
1.সরাসরি সূর্যের আলো দরকার হয়। 1. সরাসরি সূর্যের আলো দরকার হয় না।
2.NADP বিজারিত হয়। 2.বিজারিত NADP জারিত হয়।
3.থাইলাকয়েডের মেমব্রেনে ঘটে। 3.স্ট্রোমাতে ঘটে।
4.CO2 অংশগ্রহণ করে না।4.CO2 অংশগ্রহণ করে।
5.O2 উৎপন্ন হয়। 5.O2 উৎপন্ন হয়।

আরো দেখুন :C3 ও C4 উদ্ভিদের সংজ্ঞা, উদাহরণ ও পার্থক্য

পলিস্যাকারাইড : স্টার্চ,সেলুলোজ ও গ্লাইকোজেনের তুলনা

-->